ঘটনা ১: সানজানা প্রত্যাশা (ছদ্মনাম) একটি টেলিভিশন মিডিয়ায় চাকরি করছেন। প্রতি বছর নারী দিবসে তার অফিস থেকে চকলেট ও ফুল দেয়া হয়। এরপর উৎসবমুখর পরিবেশে অফিসের সব নারীরা মিলে ফটোসেশন করেন। এমনই কোনো এক নারী দিবসে তিনি পাশ থেকে শুনতে পেয়েছিলেন, তারই কোনো এক পুরুষ কলিগ বিরক্ত গলায় বলছেন, নারী দিবস নাকি হাঁড়ি দিবস, এইসব ফুল আর চকলেটের পেছনে শুধু শুধু কোম্পানী টাকাপয়সা খরচ করে। সেদিন এমন কথা শুনে সানজানা বুঝতে পেরেছিলেন, ওপরে ওপরে নারীর সমঅধিকার নিয়ে জোরগলায় কথা বলা পুরুষরা বুকের ভেতর কি ধরনের মনোভাব পুষে রাখেন।
ঘটনা ২: আফসার খান, একটা বহুজাতীয় কোম্পানীতে ক্লায়েন্ট রিলেশনশিপ অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। নারী দিবসের অর্থ তার কাছে কি- এমন প্রশ্ন করা হলে আফসার একটু মুচকি হেসে জানান, নারী দিবস তার কাছে ভালোবাসার দিবস। অফিসের এক নারী সহকর্মীকে তিনি পছন্দ করতেন অনেকদিন ধরে, কিন্তু মুখে বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। সাহসটা করেছিলেন তিন বছর আগের এক নারী দিবসে। শুভেচ্ছা জানানোর উছিলায় প্রিয় মানুষটার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ফুল। সেই থেকে শুরু। পরবর্তীতে আরো কয়েকবার ফুল দিতে দিতে একসময় জানিয়ে দিয়েছিলেন ভালোবাসার কথা। এখন তারা সুখে সংসার করছেন। ফলে নারী দিবস আফসারের কাছে মূলত ভালোবাসার দিবস। এই দিবসটা না থাকলে তিনি হয়তো তার ভালোবাসার নারীকে হারিয়েই ফেলতেন জীবন থেকে।
ঘটনা ৩: মালেকা বেগমের বয়স ৬৫। ছেলে আর ছেলের বৌয়ের সাথে একবাড়িতে থাকেন। ছেলে পেশায় সিএনজিচালক। মালেকা বেগমের কাছে নারী দিবসের দিনটা রীতিমতো অসহ্য লাগে। কারন এই দিনটায় তার ছেলে খাবার নিয়ে আসে বাইরে থেকে, বৌকে রান্না করতে দেয় না, রীতিমতো আহ্লাদি করে। সিতারা বেগমের খুব মেজাজ খারাপ হয় এসব দেখে। তিনি পদে পদে ছেলেকে শিখিয়েছেন, মেয়েমানুষদের কখনো মাথায় তুলতে হয় না, সবসময় দাবিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু তার ছেলে মায়ের কথা শোনে না। সে বরং শোনে টিভিওয়ালাদের কথা। সেখানে তারা নাকি বলে, নারীদের জন্য আলাদা একটা দিন আছে, এই দিনে নারীদের বেশি করে সম্মান করা উচিত। এইসব শুনে মালেকা বেগমের মনে তৈরি হয়েছে নারী দিসের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা।
ওপরের তিনটা ঘটনা তিনরকমের। কিন্তু তিনটা ঘটনাতেই নারী দিবসের প্রতি সাধারন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও ফুটে উঠেছে। নারী দিবস কারো কাছে বিরক্তিকর, কারো কাছে একটু বেশি সম্মান, আদর যত্ন পাবার দিন। আবার অনেকে জানেনই না এই দিবসটা কি, কেন পালিত হয়। যারা নারী দিবসের কথা জানেন, তাদের একটা বড় অংশ আবার টিভি, সোশ্যাল বা বন্ধুদের কাছ থেকে ভাসা ভাসা শুনেছেন। ফলে নারী দিবস নিয়ে একটা স্পষ্ট ছবি এখনো বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। উল্টো বিভিন্ন সময় অহেতুক বিতর্কও তৈরি হয়েছে এই দিবসটি নিয়ে। তবে যতো বাধা-বিতর্কই থাকুক, ধীরে ধীরে হলেও আমরা বুঝতে পেরেছি নারী দিবসের গুরুত্বটা। নারীদের বাদ দিয়ে যে উন্নয়ন সম্ভব না, সেটা মানুষ এখন অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারছে। শুরুতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে নারীদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করাটাই ছিলো দুরূহ। কিন্তু এখন সেই বাধা কিছুটা হলেও দুর হয়েছে, রিকশা চালানো থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজে নারীরা এগিয়ে এসেছে বীরদর্পে। কোভিড ১৯ এর কঠিন দিনগুলোর সময় আমরা দেখেছি নারী ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সংকটময় মুহূর্তে নারীদের এই যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান, সেটা ভুলে যাবার আগেই সামনের দিনগুলোতে যেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করা যায়।
নারী দিবস থীম ২০২১
প্রতিবছর নারী দিবসের ভিন্ন ভিন্ন থীম থাকে। এই বছরের থীম হচ্ছে ওমেন ইন লিডারশীপ আর #ChooseToChallenge । অন্যান্য থীমের মতো এই থীম বেছে নেয়ার পেছনেও একটা বিশেষ কারণ আছে। ভালো বা মন্দ- আমাদের মাথার ভেতর ঘুরতে থাকা সব ধরনের চিন্তাভাবনার জন্য মূলত আমরা নিজেরাই দায়ী। তাই চাইলেই আমাদের মনোভাবে লুকিয়ে থাকা চিরন্তন লিঙ্গ বৈষম্য বা নারীর প্রতি কুচিন্তাগুলোকে আমরা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারি। মন্দ চিন্তার বদলে আমরা ভাবতে পারি, কিভাবে একজন নারীর অর্জনগুলোর প্রসংশা করে তাকে আরো উৎসাহিত করা যায়। মোটকথা, একটা সুন্দর, বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হলে একে অন্যকে সাহায্য করা, উৎসাহিত করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
চ্যালেঞ্জ থেকেই আসে পরিবর্তন। তাই চলুন, সবাই চ্যালেঞ্জটাকেই বেছে নিই।